বিশেষ প্রতিবেদক: এপির পর এবার মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের জাতিগত নিধনযজ্ঞের আরও জোরালো প্রমাণ তুলে ধরেছে রয়টার্স। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বার্তা সংস্থা জানিয়েছে, ২ সেপ্টেম্বর রাখাইনের ইন দিন গ্রামে একসঙ্গে ১০ রোহিঙ্গাকে গুলি ও কুপিয়ে জখম করা হয়। এরপর তাদের একই জায়গায় মাটিচাপা দেওয়া হয়। এ সময় তাদের অনেকের দেহেই প্রাণ ছিল। প্রথমদিকে অস্বীকার করলেও জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হদ্মাইয়াং ওই ১০ জনকে ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ আখ্যায়িত করে হত্যার ঘটনা স্বীকার করেন। তবে হত্যাকাণ্ডের দায় তিনি চাপান ইন দিন গ্রামবাসীর ওপর। এই ঘটনার সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও সেখানে ছিল বলে জানান তিনি। কিন্তু রয়টার্স বলেছে, তারা অনুসন্ধানে দেখেছে নিহত সবাই ছিলেন সাধারণ রোহিঙ্গা। তাদের কারও সঙ্গেই সন্ত্রাসী কোনো গোষ্ঠীর সংশ্নিষ্টতা ছিল না। তাদের মধ্যে ৮ জনকে সেনারা গুলি করে ও দু’জনকে গ্রামের উগ্রপন্থি বৌদ্ধরা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এবং কুপিয়ে হত্যা করে। ইতিমধ্যে এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরির পেছনে কাজ করা দুই সাংবাদিক ওয়া লোন ও কিয়াও সো উকে গ্রেফতার করেছে মিয়ানমার সরকার। ১২ ডিসেম্বর গ্রেফতার হওয়া এই দুই সাংবাদিকের ওপর রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এদিকে এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর ব্রিটিশ এমপি রোজেনা অ্যালিন খান গণহত্যার অপরাধে আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিচারের দাবি জানিয়েছেন। এর মধ্যেই বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গা সংকট ও আফগানিস্তান পরিস্থিতি নিয়ে ফোনে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে হোয়াইট হাউস এ তথ্য জানিয়েছে। খবর রয়টার্স, বিবিসি, আলজাজিরা ও রেডিও ফ্রি ইউরোপের।
রয়টার্সের প্রতিবদেন জানানো হয়, ইন দিনে ওই হত্যাকাে র সঙ্গে সংশ্নিষ্ট নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য, গ্রামবাসী আর প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে পাওয়া টুকরো টুকরো তথ্য তারা মিলিয়ে দেখেছে। প্রতিবেদনে মৃত্যুর আগে হাত পিছমোড়া করে বাঁধা ১০ রোহিঙ্গার ছবিও প্রকাশ করা হয়েছে। ছবিতে তাদের পেছনে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে মিলিশিয়া বাহিনী এবং উগ্রপন্থি বৌদ্ধদের দেখা যায়। এ ছাড়া হত্যার পর রোহিঙ্গাদের রক্তাক্ত বীভৎস লাশ এবং গণকবরে পড়ে থাকা মানুষের হাড়ের ছবিও প্রকাশ করা হয়েছে।
ছবিগুলো সরবরাহ করা এক বয়োজ্যেষ্ঠ গ্রামবাসীর বরাত দিয়ে জানানো হয়, ১ সেপ্টেম্বর কাছাকাছি একটি সমুদ্রসৈকতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে ওই ১০ জনকে ধরে নিয়ে আসে সেনারা। ২ সেপ্টেম্বর প্রথমে তাদের একসঙ্গে হাত পিছমোড়া করে বেঁধে বসিয়ে রাখা হয়। বসে বসে তারা নিজেদের প্রতিবেশীদের দ্বারা অগভীর কবর খোঁড়া দেখছিলেন। অল্প সময় পরই তাদের প্রত্যেকের ঠাঁই হয় সেই কবরে। এদিন উগ্র বৌদ্ধদের দ্বারা কবর খুঁড়তে সাহায্য করেন অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য সোয়ে চে। তিনি জানান, দু’জনকে গ্রামবাসী কুপিয়ে ও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। বাকিদের প্রত্যেককে সেনারা দুই থেকে তিনবার গুলি করে। তাদের যখন কবর দেওয়া হচ্ছিল, তখনও কয়েকজনের গোঙানির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। এ ছাড়া রয়টার্সের কাছে এই ঘটনায় সংশ্নিষ্ট গ্রামবাসী ও মিলিশিয়া সদস্যরা অকপটেই স্বীকার করেছেন, কীভাবে তারা রোহিঙ্গাদের বাড়িতে আগুন দিয়েছেন, হত্যা করেছেন।
প্রতিবেদন প্রকাশের পর নিহতদের ছবি দেখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের কয়েকজন তাদের পরিচয় শনাক্ত করেছেন। তারা জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে দু’জন ছিল স্কুলছাত্র। অন্যরা পেশায় জেলে, মুদি দোকানদার ও ধর্মীয় শিক্ষাগুরু।
এদিকে এই হত্যাকাণ্ডের স্বাধীন তদন্ত দাবি করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গ্রেফতার দুই সাংবাদিককে মুক্তি দিতে মিয়ানমারকে আহ্বান জানিয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হিদান নোয়ার্ট বলেন, গণকবরের আগের খবরগুলোর মতোই এই প্রতিবেদনটি নিয়েও মিয়ানমারের উচিত স্বাধীন ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত করা। যে ঘটনা ঘটেছে তার সার্বিক চিত্র পেতে, খুনি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করতে সহযোগিতা করা হবে। অন্যদিকে ব্রিটিশ লেবার পার্টির এমপি রোজেনা অ্যালিন খান বিবিসিকে এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এই প্রতিবেদন একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। কারণ আগস্টের পর প্রথমবারের মতো এ ধরনের ঘটনার বিস্তারিত প্রকাশ পেল। এবার খোদ নিপীড়কদের কাছ থেকেই শুনছি কীভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে।
এর আগে এপির অনুসন্ধানে রাখাইনের গু দার পাইন গ্রামে রোহিঙ্গাদের পাঁচ গণকবরের খবর পাওয়া যায়। সেখানে শিশুসহ কমপক্ষে ৪০০ রোহিঙ্গাকে হত্যা করে কবর দেওয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।